বাজার শব্দ হিসেবে আমাদের কাছে নিত্য ব্যবহার্য, কিন্তু প্রত্যয় হিসেবে এর ব্যবহার কম। বিজ্ঞান-বাণিজ্য-মানবিক শাখাত্রয় এর কল্যানে শব্দটির পরিচিতি নিতান্ত কম নয়। বাজার প্রত্যয়টির সংজ্ঞায়ন আরো জটিল করে তুলেছে এর ‘লিকুইডিটি’ (liquidity)।
বাজারের ইতিহাস আর নগরের ইতিহাস অবিচ্ছেদ্য। ইতিহাস বলে বাজারকে কেন্দ্র করেই নগর গড়ে উঠেছিল। এবং নগরে-নগরে বা “সভ্যতায়-সভ্যতায়” যে যোগাযোগ তা মূলত বাজারে-বাজারে যোগাযোগ। অর্থাৎ, সেসময় বাজার “স্থানিক” ছিল। সেই বাজার ক্রমানয়ে আঞ্চলিক, আন্তঃরাজ্য ,আন্তঃমহাদেশীয়, এরপর আন্তর্জাতিক চেহারা লাভ করেছে। প্রাথমিক অবস্থায় পুঁজিবাদ নামক গরুর দুধ, আর সভ্যতার চিনিমিশ্রিত অবস্থায় উপনেবিশবাদের কাচের গ্লাসে পরিবেশন, অত:পর বাজারের এই দ্রুত বিস্তার। এরপর নিওলিবারাল হরলিকস, ফ্রি মার্কেট গুড়া দুধ আর উন্নয়নের সুইটনার সহ গণতন্ত্রের সোনার গ্লাসে ঢকঢক পান করা। ফলে বাজারের সংজ্ঞায়ন বারবার পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত, সংযোজিত এবং পরিমার্জিত হয়েছে। এবং বাজার পরিনত হয়েছে তারলিক প্রপঞ্চে।
বাজার শব্দটি ফারসি। বাংলায় ‘হাট’ শব্দটি এর আংশিক সমার্থক। আবার ‘হট্ট’ শব্দটির একটি অর্থ ‘বাজার’। বাজার এর আরেকটি অর্থ ‘বিপুলতা’ (দাশ, ২০১৭:০৩)। নিত্যব্যবহার্য অর্থে ‘বাজারে যাওয়া যায়’, ‘বাজার করতে যাওয়া যায়’, ‘বাজারজাত করা যায়’। অর্থাৎ, আমরা বাজার প্রত্যয়টির সংজ্ঞায়নের সাথেই ‘ভোগ’ (Consumption) এবং মার্কেটিং (Marketing) এর ধারনা যোগ করে দিয়েছি।
“উৎপাদন” কিন্তু বাজারের এই সংজ্ঞার সাথে যোগ করা যায়নি বা হয়নি। আনুমান করি, এর কারন দুইটা। প্রথমত, বর্গী এবং গং এই অঞ্চলে আসার পর থেকে তাদের ‘উৎপাদিত’ পণ্য আমরা ‘ভোগ’ করে আসছি। আমরা আমাদের কিছু পণ্য, যেমন: মসলিন, ‘বাজারজাত’ করেছি। খেয়াল করেন, আমরা মসলিন ‘বাজারজাত’ করছি, উৎপাদন না। কেন এর নাম ‘বাজারজাত’ হবে, কেন আমরা ‘বাজার করতে যাব’ বললে ‘বাজারজাত করতে যাব’ না বুঝে ‘ভোগ করতে যাব’ বুঝব সেটাই আজকের মূল প্রসংগ। দ্বিতীয়ত, উৎপাদনকারী উৎপাদন করত ‘নিজের’ ভোগের জন্য অথবা আরেক উৎপাদনকারীর সাথে বিনিময়ের জন্য। যেহেতু সেসময় অনেকটা বন্ধ অর্থনীতি (Closed economy) চর্চা হত, তাই উৎপাদনকারী ও ভোগকারী খুব কম দুরুত্বে (Close Proximity) বসবাস করত। ফলে তাদের মধ্যে এক প্রকার নৈতিক বাধ্যবাধকতা (Moral Obligation) কাজ করত যা এই বিনিময় সম্পর্কের (Reciprocal Relationship) মূল ভিত্তি। উপনেবিশবাদ এই সম্পর্কটাকে লিকুইডিফাইড (Liquidified) করে। ফলে উৎপাদনকারী উৎপাদকে কম ‘own’ করে বা করেই না।
(চলবে)
রেফারেন্স: পূর্ণেন্দুকান্তি দাশ, ২০১৭, ‘আমার কাল, আমার ভুবন’, পারুল বৈদ্যুতিন সংস্করণ