লউরা নাদার (Laura Nader) এর আলোচনাটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তিনি জুপোটেক ইন্ডিয়ানদের উপর ম্যাক্সিকোর ওহাকা প্রদেশের তালিয়া গ্রামে একটা গবেষণা করেন। এই গবেষণা তিনি প্রকাশ করেন ১৯৯০ সালে তার বই Harmony Ideology: Justice and Control in a Zopetec Mountain Village এবং ১৯৮০ সালে নির্মিত তার ডকুমেন্টারি ফিল্ম Littile Injustices: Laura Nader Looks at the Law-এ। আমাদের আলোচনা এই অংশে কেন্দ্রীভূত হবে এই ডকুমেন্টারির উপর।
এখানে তিনি দেখিয়েছেন একটি প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজে, যেখানে সব মানুষ সবাইকে চেনে, বিশেষত উৎপাদক এবং ভোক্তা একে অপরকে চেনে সেখানের বাজার ব্যবস্থা এবং জবাবদিহিতা কি রকমের এবং সমসাময়িক আরেকটি সমাজ (ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা) যেখানে উৎপাদক এবং ভোক্তা পরস্পরকে চেনে না, সেখানে জবাবদিহিতা কি রকমের। এই এথনোগ্রাফি থেকে স্পষ্ট যে বাজারে উৎপাদক এবং ভোক্তার মধ্যে দুরত্ব যত বাড়ে, ভোক্তা অধিকার ও জবাবদিহিতা তত কমে। অর্থাৎ, Face-to-Face প্রোডাকশন, Face-to-Faceless প্রোডাকশন এর চেয়ে বেশি ভোক্তা সন্তুষ্টি আদায় করে নিচ্ছে। কিন্তু বাজারের মহাগুরু এডাম স্মিথ (1776) তার বাজার বিষয়ক ওকালতির কেন্দ্রে রেখেছিলেন ভোক্তাকে, যাকে ঘিরে বাজার আবর্তিত হবে। ফলত ব্যক্তিস্বাধীনতার গুণগান এবং Free Agent হিসেবে ব্যক্তির পুনঃ পরিচয়। যা সরাসরি উপরোক্তি কথাবার্তার বিপরীত।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এর সাথে জড়িত, তা হল Division of Labor বা শ্রমবিভাজন। অর্থাৎ, উৎপাদিত পণ্য কেউ পুরোটা বানাবে না। সবাই পুরো জিনিসটার কিছু কিছু অংশ করে বানাবে। বর্তমান ক্ষেত্রে দেখা যায় এই অংশবিশেষের একটি বানানো হচ্ছে এক দেশে, আরেকটি আরেক দেশে।
মনে করেন আপনি একটি শার্ট বানাবেন। কাপড় কিনলেন ইন্ডিয়া থেকে, শার্টের কলার বানালেন শ্রীলংকায়, ভিয়েতনাম বানালো শার্টের হাত, বোতাম বানালো কংগো, ডিজাইন করল ফ্রান্স, ডাই করল জার্মানি আর সব অংশগুলোকে জোড়া দিল বাংলাদেশ। এবার একটি আমেরিকা ভিত্তিক কোম্পানি এই শার্টকে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে সরবরাহ করবে বলে ভাবল। এই কাজে তারা সহায়তা নিল যুক্তরাজ্য ভিত্তিক একটি কোম্পানির। যেহেতু এটার প্রচার করতে হবে তাই তারা রাশিয়ান টেনিশ তারকা শারাপোভা ও সুইডেনের রজার ফেদরারকে বানালেন এর এম্বাসেডর।
সহজ ভাষায় এই হল শ্রমবিভাজন। সারাহ বেন্ডার এই সংক্রান্ত একটি চমৎকার গবেষণা করেছেন ২০০২ সালে। সেখানে তিনি বলেছেন Adidas, Nike, Apple, GAP সহ আরো অনেক কোম্পানি তাদের পণ্য বানায় চীনে। তার একটি গবেষণার শিরোনাম পুরো ব্যাপারটি আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। শিরোনামটি হল “Designed by Apple in California, Assembled in China- The New International Division of Labour”। আবার মহাগুরু এবং তার কিতাব Wealth of Nations (1776) এর শরণাপন্ন হচ্ছি। এখানে তিনি বলেছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এই Division of Labour গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজন। তিনি আরো মনে করেন এতে করে উৎপাদন ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। কেননা শ্রমিকরা একটি মাত্র কাজ বারবার করে।
এই শ্রমবিভাজন এর ফলাফল হচ্ছে কোন শ্রমিক পুরো পণ্য বানাতে পারে না, এমকি কিভাবে বানায় তাও জানে না। যেহেতু মাত্র একটি অংশের জন্য সে দায়ী, তাই পুরো পণ্য ফেইল করলেও সেখানে সে নিজের দায়ভার খোঁজে না বা নেয় না। এবার একজন শ্রমিকের জায়গায় কল্পনা করি পুরো একটি ফ্যাক্টরিকে। ফলাফল একই থাকে। এটাতো শুধু উৎপাদন-শ্রমিকের কথা গেল। বুদ্ধিজীবী-শ্রমিক, খবরদারি-শ্রমিক সবার বেলায়ও একই যুক্তি খাটে। সবাই পুরো প্রক্রিয়ার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ, তাই পণ্যের ব্যর্থতা তার নিজের ব্যর্থতা নয়, অন্তত তার কাছে।
এই শ্রমবিভাজনই হচ্ছে Faceless-production এর জননী, যার ফলাফল হচ্ছে ‘পণ্য’ কে own না করা। আরেকটি ঘটনা একই সাথে ঘটছে, তা হল শ্রমিকের শোষণ। যেহেতু তারা শুধুমাত্র একই ধরনের কাজ পারে, তার পক্ষে পুরো প্রক্রিয়াটি জেনে ফেলা বা পুরো প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে থেকে নতুন আবিস্কার কমে যাবে, অথবা শ্রমিক কেবল তার নিজের কাজের ‘replacement’ আবিস্কার করতে পারবে। যা ফলশ্রুতিতে তার এবং তার মত অন্যদের replace করে ‘বেকার’ করে দিবে। অর্থাৎ, শ্রমিক এই বিভাজিত শ্রমের মধ্যে শোষিতই হবে শুধু।
আমার মতে, শ্রমবিভাজন এবং Faceless production কেবল শ্রমিকের শোষণ বৃদ্ধি করেছে তা নয়, বরং একই সাথে তা ভোক্তার শোষণ ও নিপীড়ন বৃদ্ধি করেছে। অর্থাৎ, পুঁজিপতি ‘দুইবার’ লাভবান হচ্ছে। একবার শ্রমিকের দ্বারা, একবার ভোক্তার দ্বারা। নাদের তার গবেষণায় দেখান যে আমেরিকার শ্রমবিভাজন নির্ভর Faceless-production ভোক্তাদের কাছে জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে কিভাবে ব্যর্থ। বারবার তার কথায় উঠে এসেছে যে, কেউ এই ব্যর্থতার দায় নেয় না, নিতে চায় না, নিচ্ছে না। কেননা, আমার বিশ্বাস, শ্রমবিভাজন পণ্যর Ownership নষ্ট করে দিচ্ছে ফলে শ্রমিক-মালিক কেউই পণ্যর মালিক নয়, তারা বরং মুনাফার মালিক-শ্রমিক।
Reference: